গেল বছর আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৫ আগস্ট রাতে গণমাধ্যমকর্মী কামরুল ইসলামের কাছে খবর আসে ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী বাংলাদেশের থানাগুলোতে আটকা পড়েছে এবং তারা সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালাচ্ছে। ফেসবুক ফিডেও এ সংক্রান্ত অসংখ্য ভিডিওতে দাবি করা হয়— এক রাতের মধ্যে ভারত বাংলাদেশ দখলের পাঁয়তারা করছে। পরদিন সকালে তথ্য যাচাই করে কামরুল জানতে পারেন পুরো ব্যাপারটিই ছিল গুজব এবং ডাহা মিথ্যা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন আজগুবি, বানোয়াট, গুজব, অপতথ্য এবং মিথ্যা তথ্যের ছড়াছড়ি নিত্যদিনের ঘটনা। বাংলাদেশি ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্ট ওয়াচের জরিপ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা প্রক্রিয়ায় ৬৩৮টি অপতথ্য ছাড়ানো হয়েছে।
এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি অপতথ্য ছড়িয়েছে গত বছরের আগস্টে। একমাসে বিভিন্ন মাধ্যমে ৯১টির বেশি অপতথ্য ছড়ানো হয়। আগস্ট মাসে ছড়ানো অপতথ্যের মধ্যে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ভুয়া খবর। এর বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যু, ইসরায়েলে ইরানের হামলা, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে অসংখ্য অপতথ্য ছড়িয়েছে বছরজুড়ে।
যারা এ ধরনের অপতথ্য ছড়ান তারা সিংহভাগ সময়ে সহজ মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো যোগাযোগমাধ্যমকে। সাধারণ মানুষ এ ধরণের তথ্য দেখেন এবং আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই নিজের পেজে বা অ্যাকাউন্টে শেয়ার করেন। এতে করে বিশাল সংখ্যক মানুষের কাছে মুহূর্তেই ভুল তথ্য পৌঁছে যায় এবং মানুষ সে অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখায়। অনেক সময় এর ফলাফল হয় ভয়াবহ।
কোনো ধরনের ফ্যাক্ট চেক না করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল তথ্যের বন্যা বয়ে যাওয়ার কারণ প্রসঙ্গে ফ্যাক্ট ওয়াচের গাইডেন্স এডিটর অধ্যাপক সুমন রহমান বলেন, যারা অপতথ্য ছড়ায়, তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য মোক্ষম সময় এবং সুযোগ খুঁজে নেয়। বেশিরভাগ অপতথ্য এমনভাবে ছড়ানো হয়, যা কিনা মানুষের আবেগকে নাড়া দেয়। মানুষ আবেগের বশবর্তী হয়ে যাচাই-বাছাই না করেই সেসব তথ্য বিশ্বাস করে এবং শেয়ার করে। এতে রীতিমতো গুজবের বন্যা বয়ে যায়।
এমনটাই ঘটেছিল গণমাধ্যমকর্মী কামরুল ইসলামের বেলায়। কামরুল বলেন, 'সেদিন রাতে আমি তথ্য যাচাই না করেই আমার সহকর্মীদের ফোন দিয়ে জানাই এমন ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। তারাও সেটি যাচাই-বাছাই না করে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এ ধরনের ভিডিও শেয়ার দিতে থাকে। বাকিরাও হয়তো এভাবেই তথ্যগুলো নিজেদের অজান্তে ছড়িয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে পুরো রাতটা ছিল গুজব আর অপতথ্যের মধ্য দিয়ে কাটানো একটা সময়।'
অধ্যাপক সুমন বলেন, 'বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা দেখে তা ক্রসচেক করে না। এটা সত্যি-মিথ্যার থেকেও তাদের কাছে বড় ব্যাপার হয়ে ওঠে। এটা তার আবেগকে নাড়া দিচ্ছে কিনা এবং সে চায় বাকিরাও তার সঙ্গে আপ্লুত হোক।'
আরও পড়ুন: আশুলিয়ায় গুজব ছড়িয়ে সহিংসতা করা হয়েছে: শ্রম উপদেষ্টা
মেটা ফ্যাক্ট চেকিং
সম্প্রতি মেটা (ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ) যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের ফ্যাক্ট-চেকিং ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতদিন তৃতীয় পক্ষ হিসেবে মেটার তথ্য,ছবি ও ভিডিও'র ফ্যাক্ট-চেকার হিসেবে কাজ করা আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট-চেকিং নেটওয়ার্কের (আইএফসিএন) বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে মার্ক জাকারবার্গ জানান, প্রতিষ্ঠানটি রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট এবং পাশাপাশি পোস্টে অতিরিক্ত সেন্সরশিপ আরোপ করছে।
নিজেদের আত্মপক্ষ সমর্থন করে আইএফসিএন বলছে, ফেক্ট-চেক প্রতিষ্ঠান নয়, বরং মেটা রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতী। বারবার মেটাকে রাজনৈতিক নেতাদের অপতথ্য ছড়ানো প্রসঙ্গে ব্যবস্থা নিতে বলা হলেও প্রতিষ্ঠানটি থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
যেভাবে মেটা যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের ফ্যাক্ট-চেকিং থেকে সরে এসেছে একইভাবে এশিয়াসহ অন্যান্য দেশেও নিজেদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে চাইলে গুজব এবং অপতথ্যের সংখ্যা অনেক বেশি বেড়ে যাবে বলে মতো বিশ্লেষকদের।
আরও পড়ুন: ফারাক্কা বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার গুজব ও ভুয়া ভিডিও প্রত্যাখান দিল্লির
এ ব্যাপারে বার্তাসংস্থা এএফপির বাংলাদেশের ফ্যাক্ট-চেক এডিটর কদরউদ্দিন শিশির বলেন, মেটার ফ্যাক্ট-চেকিং থেকে সরে আসা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ ধরনের সিদ্ধান্ত ইউরোপ বা এশিয়ার ওপর আরোপ করা মেটার জন্য কঠিন হবে। ইউরোপের আইনেই আছে, কোনো প্ল্যাটফর্ম থেকে মিথ্যা নিউজ শেয়ার হলে বা অপতথ্য ছড়ালে দায়ী হবে খোদ প্ল্যাটফর্ম। একইভাবে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মতো দেশে অনেক ভুয়া নিউজের জন্য দাঙ্গা এবং সংঘর্ষের মতো ঘটনা আছে। রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্যও নানা বিষয়ে মোটা দাগে ফেসবুকে ছড়ানো ভুল তথ্যকে দায়ী করা হয়। এমন একটি স্পর্শকাতর অঞ্চলে মেটা ফ্যাক্ট-চেকিং বন্ধ করে দিলে সেটা মোটেই ভালো ফল বয়ে আনবে না।
মেটার সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টতা বাড়ানো প্রসঙ্গে শিশির বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত মেটাকে এখানে ফ্যাক্ট-চেকের পরিধি আরও বাড়াতে চাপ প্রয়োগ করা। এছড়া ফ্যাক্ট চেক শুধু মেটার ওপর ছেড়ে না দিয়ে অন্যান্য পক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বাড়ানো উচিত। ইউটিউবে কোনো ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের ব্যবস্থা নেই। অথচ এই প্ল্যাটফর্মকে অনেক অপতথ্য ছড়ায়। এটিও বন্ধে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
সাংবাদমাধ্যমে ফ্যাক্ট-চেকিং
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা যায়, গত বছর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সংবাদমাধ্যমে যেসব সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে তার বড় একটি অংশ গুজব কিংবা অপতথ্য- এমন অভিযোগ তুলেছেন দেশটির সাধারণ মানুষ।
যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের ৭৩ শতাংশ বিশ্বাস করেন মূলধারার গণমাধ্যমে হরহামেশা অপতথ্য ছড়ানো হয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্র না, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও মূলধারার গণমাধ্যম থেকেও ভুল সংবাদ প্রকাশের তালিকা কোনো অংশে কম নয়।
এ প্রসঙ্গে এএফপির শিশির বলেন, পৃথিবীর প্রতিটি বড় বড় সংবাদমাধ্যমে ফ্যাক্ট-চেক ডেস্ক আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মিডিয়াগুলোতে এ ধরণের কোনো ডেস্ক নেই। এতে করে একটি সংবাদ সঠিক নাকি ভুল অনেক সময় সংবাদকর্মী নিজেই তা যাচাই করেন না বা জানেন না কীভাবে যাচাই করতে হবে। গণমাধ্যম অফিসে ফেক্ট-চেকার থাকুক বা না থাকুক, একজন সাংবাদিক ফ্যাক্ট-চেকিং না জানলে কোনোদিনও ভালো সাংবাদিক হয়ে উঠতে পারবেন না।
স্বাধীন ফ্যাক্ট-চেকিং কমিশন
ফ্যাক্ট চেকিংয়ের জন্য মেটা বা তৃতীয় কোনো পক্ষের ওপর নির্ভর করা বর্তমানে এসে বুদ্ধিদীপ্ত কোনো পদক্ষেপ হতে পারে না বলে মনে করেন গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে বড় সম্ভাবনা থাকে করপোরেট ফ্যাক্ট-চেক প্রতিষ্ঠানের নিজ সুবিধা আদায়ে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক মফিজুর রহমান বলেন, সরকার গণমাধ্যম সংস্কারে কমিশন গঠন করেছে। এই কমিশনের উচিত দেশে স্বাধীন ফ্যাক্ট-চেক কমিশন গঠনের সুপারিশ করা। ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান যদি সরকার মদদপুষ্ট কিংবা করপোরেট সুবিধাপুষ্ট হয়, তাহলে নিরপেক্ষ ফ্যাক্ট উঠে আসবে না।
স্বাধীন ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে একইভাবে ফ্যাক্ট-ওয়াচের অধ্যাপক সুমন বলেন, ফ্যাক্ট চেকের জন্য মেটার ওপর নির্ভরশীল হওয়ার দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল ভালো হবে না। মানুষের মধ্যে গণমাধ্যম সচেতনতা বাড়াতে হবে। একটি সংবাদ বা তথ্য কীভাবে যাচাই করতে হয়, সেটি শিখলে সাধারণ মানুষই এক একজন ফ্যাক্ট চেকার হয়ে উঠতে পারবেন।
আরও পড়ুন: প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনে সেনাবাহিনী জড়ো হয়নি, গুজব ছড়ানো হয়েছে